দেশের খবর

ভারতবর্ষের এই গ্রামের কোন বাড়ির সদর দরজা নেই, এমনকি পুলিশ স্টেশনের!! কি হয়েছিল ৩০০ বছর আগে??

তনুশ্রী ভান্ডারী ডেক্স ঃ-বর্তমান সময়ে ভাবুন তো এই ভারতের বুকেই রয়েছে এমন একটি গ্রাম যেখানে কোনো বাড়িতেই লাগানো নেই দরজা। এমনকি দোকানগুলোও সর্বদাই রয়েছে খোলা! ভাবা যায়? সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো স্থানীয়রাও কিন্তু কোনোভাবেই এই গ্রামে অনিরাপদ বোধ করেন না।হয়তো ভাবছেন মজা করছি! কিন্তু তেমনটা কিন্তু নয় মোটেও।

আজ আপনাদের শোনাবো মহারাষ্ট্রের শনি শিংনাপুর নামক এক গ্রামের গল্প। এই গ্রামের বাসিন্দারা গ্রহের দেবতা শনিকে নিজেদের অভিভাবক বলে মনে করেন। তাদের মতে ভগবানের কৃপায় তাদের কোনোরকম ক্ষতি কখনো হতে পারবে না। আর এই ভরসা থেকেই তাদের বিশ্বাস যে ঘরে বা দোকানে আলাদা করে কোনো দরজা লাগানো বা তলা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। জনশ্রুতি অনুযায়ী আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে ভয়ানক এক বন্যার পর, গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পানাসনালা নদীর তীরে হঠাৎই এক ভারী কালো পাথর ভেসে উঠেছিল। স্থানীয়রা লাঠি দিয়ে ওই ১.৫ মিটার চওড়া পাথর স্পর্শ করলে সেখান থেকে নাকি রক্ত ​​বেরোতে আরম্ভ করে
।শোনা যায় পরে সেই রাতে, স্বয়ং দেবতা শনি গ্রাম প্রধানের স্বপ্নে আবির্ভূত হন এবং জানান যে পাথরটি আসলে তার নিজের মূর্তি। তার আদেশ ছিলো পাথরটি যেনো গ্রামের এমন এক জায়গায় স্থাপন করা হয় যেখানে তিনি একা শান্তিতে থাকতে পারবেন। তবে একই সাথে শনির আরেকটি একটি শর্ত ছিল: শিলা এবং এর বিশাল শক্তি যেনো সর্বদা বিনা বাঁধায় গ্রামের তত্ত্বাবধান করতে সক্ষম হতে হয় সেই ব্যবস্থা রাখা।কথিত আছে সব শর্ত নত মস্তিষ্কে মেনে নেওয়ার পর শনি গ্রামের নেতাকে আশীর্বাদ করেন এবং গ্রামকে সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।

গ্রামবাসীরা দেবতার আদেশ অনুযায়ী শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি ছাদবিহীন প্ল্যাটফর্মে পাথরটি স্থাপন করে সমস্ত ঘর থেকে দরজা এবং তালা খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপত্তার জন্য এই সবের প্রয়োজনীয়তা আর তাদের ছিলো না, স্বয়ং প্রভুর আশীর্বাদ ছিলো তাদের সাথে। বংশ পরম্পরায় বহুদিন ধরে চলে এসেছে এই ঐতিহ্য। স্থানীয়রা মাঝে মাঝে কুকুরদের ঘরে প্রবেশ রোধ করতে সামনের দরজার ফ্রেমে কাঠের প্যানেল ঠেকিয়ে রাখে ঠিকই কিন্তু আজও স্থায়ী কোনো দরজা নেই বেশির ভাগের বাড়িতেই। ঘরে গহনা এবং অর্থ অরক্ষিত অবস্থায় থাকলেও তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ভগবান শনি ঠিকই তাদের যেকোনো দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করবেন। এমনকি গ্রাম চত্বরে পাবলিক টয়লেটগুলিতেও দরজা নয় বরং গোপনীয়তার স্বার্থে প্রবেশপথে একটি পাতলা পর্দা থাকে৷ শুধু পুরনো নয়, নতুন নির্মিত বাড়িগুলিও এই প্রাচীন প্রথাকে সম্মান করেই তৈরি হয় এখানে। বছর কয়েক আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৈরি হওয়া পুলিশ স্টেশনেও নেই কোনো সদর দরজা। জানলে অবাক হবেন এতো বছরে এখনো একবারও পুলিশ গ্রামবাদীদের কাছ থেকে কোনো রকম অভিযোগ পায়নি। বাদ যায়নি ব্যাংকও। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক ২০১১ সালে শনি শিংনাপুরে গ্রামবাসীদের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতের প্রথম “লকলেস” শাখা খোলে সেখানে। নিরাপত্তার জন্য এখানে লাগানো হয়েছে কেবল একটি স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি প্রবেশদ্বার এবং রিমোট-নিয়ন্ত্রিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক লক মাত্র৷
স্থানীয়রা নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই কম চিন্তিত যে প্রয়োজনে কখনো গ্রামের বাইরে যেতে হলেও প্রতিবেশীদের তারা কখনো বাড়ির খেয়াল রাখতে বলেন না। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস চোর ঘরে প্রবেশ করলে অবিলম্বে ভগবানের রোষের মুখে পড়ে অন্ধ হয়ে যাবে এবং সাড়ে সাত বছর ভয়ানক দুর্ভাগ্য চলবে তার। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায় এক গ্রামবাসী দেবতার কথা অমান্য করে একবার বাড়ির প্রবেশদ্বারে কাঠের প্যান স্থাপন করেছিল এবং তার ঠিক পরের দিনই নাকি গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি।

এই অদ্ভুত ইতিহাসের কারণে, সারা বছর ধরেই শনি শিংনাপুরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘুরতে আসেন বহু শনি ভক্ত। প্রত্যেকদিন ভগবানের দর্শন পেতে এখানে আগমন ঘটে অন্তত ৪০,০০০ দর্শনার্থীর। এক সময়ের ছোট্ট শনি মন্দিরটি বর্তমানে ভক্তদের দানে পরিণত হয়েছে একটি বড় মন্দিরে।উল্লেখ্য, শনি শিংনাপুর গ্রামটি আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েক শতাব্দী ধরে একেবারে অপরাধ মুক্ত থাকলেও, ২০১০ সালে একবার একজন দর্শনার্থী রিপোর্ট করেছিলেন যে তার গাড়ি থেকে ৩৫,০০০ টাকা মূল্যের নগদ এবং বেশ কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়েছে। এমনকি ২০১১ সালেও ৭০,০০০ টাকা মূল্যের সোনার অলঙ্কার চুরির ঘটনাও ঘটেছিল সেখানে। তবে গ্রামবাসীদের দাবি এই প্রত্যেকটা ঘটনাই ঘটেছে গ্রামের বাইরে।

এর বিরুদ্ধমতও যে নেই তেমন কিন্তু নয়। অনেকেই যুক্তি দেন যে গ্রামটির নেহাত প্রত্যন্ত অবস্থানের কারণেই এখানে অপরাধ মূলক কর্মকান্ড এতটা কম। তাদের মতে এর সাথে ভগবানের কোনো রকম অলৌকিক ক্ষমতার কোনো যোগ নেই।তবে সত্য যাই হোক না কেন, যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে পুরোনো চিন্তাধরা এবং বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটছে এখানেও। বর্তমানে বেশ কিছু গ্রামবাসী তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ঘরে দরজা এবং তালা বসানোর জন্য গ্রাম-পঞ্চায়েতের থেকে অনুমতি চাইতে আরম্ভ করেছে।

অবশ্য এরপরেও শনি শিংনাপুরের বেশিরভাগ বাসিন্দাদেরই আশা যে বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা পুরোনো এই ঐতিহ্যটি ঠিকই বজায় থাকবে গ্রামে এবং পুরাতন কালের মতোই ভগবান শনি ভবিষ্যতেও তাদের প্রত্যেককে কুনজর থেকে ঠিক এভাবেই আগলে রাখবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *