নির্দিষ্ট দু-চারজন নয়, এবার বেকায়দায় পড়লেন বাংলার সব প্রাথমিক শিক্ষক। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থাৎ তৃণমূল আমলে যারা যারা TET পাশ করে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের সবাইকে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী এবার স্বচ্ছ নিয়োগের স্বপক্ষে নথি জমা দিতে হবে।
খাতায়-কলমে একে ভেরিফিকেশন বলা হলেও তা কার্যত শিক্ষক হিসেবে তাঁদের নিয়োগ যে সঠিক সেটা প্রমাণ করার সামিল। আর পুরোটাই হচ্ছে আদালতের নির্দেশে।
প্রথমে SSC নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে মামলা হয় কলকাতা হাইকোর্টে। তার তদন্তভার আদালত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়। পরে বেআইনি আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ মেলায় ইডিও তদন্ত শুরু করে। এরপর প্রাইমারি টেট পরীক্ষার ফলে কারচুপি ও শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
এক্ষেত্রেও কলকাতা হাইকোর্টে সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেয়। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এক্ষেত্রেও বেআইনি আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখছে। তারাই তৃণমূল জামানায় নিযুক্ত সকল প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি সংক্রান্ত যাবতীয় নথি চেয়ে পাঠিয়েছে।
কতজনকে চাকরির প্রমাণ দিতে হবে?
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে টেট পরীক্ষা হয়। সবমিলিয়ে গত ১১ বছরে প্রায় ৬০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। সরকারি পে-স্কেল মেনে তাঁরা বেতনও পাচ্ছেন। Primary TET Scam এর তদন্তে নেমে ইডি’র নজর পড়েছে এই বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষকদের দিকে।
কেন্দ্রীয় এজেন্সিটির ধারণা, এদের একটা বড় অংশের নিয়োগ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হয়নি। বেআইনি আর্থিক লেনদেন, অর্থাৎ ঘুষ, মেধা তালিকায় কারচুপি করে তাঁরা শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। তাই গত ১১ বছরে রাজ্যের স্কুলগুলিতে প্রাথমিক শিক্ষক পদে যতজন নিযুক্ত হয়েছেন সকলের চাকরির সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ED)।
যেসমস্ত তথ্য জমা দিতে হবে?
তৃণমূল জামানায় নিযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের যাবতীয় তথ্য চেয়ে ইডি রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে চিঠি পাঠায়। এরপরই নবনিযুক্ত পর্ষদ সভাপতি গৌতম পালের নেতৃত্বে বৈঠকে বসেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কর্তারা। কারণ এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষকের নথি দ্রুত সংগ্রহ করে ইডি’র হাতে তুলে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
সেই বৈঠকে ঠিক হয় কোন পথে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের যাবতীয় নথি বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা হবে। সেই মোতাবেক রাজ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ থেকে প্রতিটি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের কাছে চিঠি চলে গিয়েছে।
ওই চিঠিতে জানানো হয়েছে, ২০১১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার যারা পেয়েছেন এবং সেই চাকরি করছেন, তাদের প্রত্যেককে টেট পরীক্ষার রোল নম্বর, তার প্রাপ্ত মার্কস ও শংসাপত্র, নিজের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট, ডিএলএড ট্রেনিংয়ের শংসাপত্র, শিক্ষক পদে নিয়োগের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের প্রতিলিপি, পে-স্লিপ ইত্যাদি নথি পাঠাতে হবে।
এর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাট তৈরি করেছে। ফলে বিভিন্ন জরুরি নথির প্রতিলিপির পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষককে একটি ফর্ম ফিলাপও করতে হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই বেশিরভাগ জেলা তাদের অধীনে থাকা শিক্ষকদের থেকে নথি সংগ্রহ করে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কারণ ৯ সেপ্টেম্বর রাজ্য দফতরে এই সংক্রান্ত নথি জমা করার শেষ দিন ধার্য করা হয়েছিল। আগামী সপ্তাহেই রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষকের এই নথি ইডি’র কাছে পাঠিয়ে দেবে বলে খবর।
শিক্ষক মহলে আতঙ্ক সৃষ্টি
তবে ইডির নির্দেশের ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের এই নথি চাওয়ার ঘটনায় শিক্ষক মহলে বেশ আতঙ্কে সৃষ্টি হয়েছে। যাঁরা স্বচ্ছতার সঙ্গে শিক্ষকের চাকরি করছেন, তাঁরা মনে করছেন দু-চারজন অসাধু শিক্ষকের জন্য তাদের ভবিষ্যৎ এবার প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
তাছাড়া সামাজিক স্তরেও প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে নানান ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হচ্ছে। সবমিলিয়ে শিক্ষক সমাজের একটা বড় অংশ বর্তমান ঘটনাক্রমে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। সেইসঙ্গে অনেকেই চাকরি থাকবে কিনা সেই আশঙ্কায় ভুগছেন।